ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস এবং এর গুরুত্ব, তাৎপর্য, রাজনৈতিক পটভূমি, অর্থনৈতিক পটভূমি ও দফাসমূহ

six point programe

ছয় দফা দিবস আজ। ব্রিটিশ শাসন, শােষণ ও হিন্দু আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৪৭ সালে স্বাধীন ও সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠি পূর্ব পাকিস্তানকে একটি উপনিবেশে পরিণত করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় । পাকিস্তানি শাসনের ২৩ বছরের ইতিহাসে বাঙালিদেরকে সকল দিক থেকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যে যে সব কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়ােজন তার সব কিছুই পাকিস্তান সরকার গ্রহণ করেছে। ফলে এ সময়ে বাঙালি জনগােষ্ঠি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিকসহ সকল দিক দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পিছিয়ে পড়ে। তারা হয়ে পড়ে অবহেলিত ও বঞ্চিত।

সুতরাং পশ্চিমা শাসক গােষ্ঠির ঔপনিবেশিক শাসন ও শােষণ থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহােরে অনুষ্ঠিত বিরােধী দলসমূহের সম্মেলনে ৬ দফা দাবি পেশ করেন। তার ৬ দফা দাবি উত্থাপন পাকিস্তানের ইতিহাসে কোনাে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তাই ৬ দফা দাবি উত্থাপনের পেছনে একটি সুদীর্ঘ পটভূমি আছে।

এখানে রয়েছে- 

  • ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস কত তারিখে?
  • ছয় দফা দিবস ৭ জুন কেন?
  • ছয় দফা দিবস ক্যানো পালিত হয়?
  • ছয়দফা দাবি মোট কত বার ঘোষনা করা হয়?
  • ছয় দফা অনুমোদন পায় কবে?
  • ছয় দফা বাস্তবায়নের জন্য হরতাল পালিত হয় কবে?
  • ছয় দফার দফাসমূহ (Terms of Six Point Programe)
  • ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য (Reaction, Importance and Significance of Six points Program)
  • ছয় দফা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (Six point and Bangali Nationalist Movement)
  • ছয় দফা দাবির রাজনৈতিক পটভূমি (Political Background of Six point Demand)
  • ছয় দফা দাবির অর্থনৈতিক পটভূমি (Economical Background of Six point Demand)
  • ৬ দফা আন্দোলনে সরকারের প্রতিক্রিয়া (Reactions of the Six points Programe)
  • ৬ দফা আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া (Reaction of Different Political Parties)
  • ছয় দফার পক্ষে আওয়ামী লীগের প্রচারণা (Campaign of Awami League in Favour of Six Point Programe)

Part of This Content

ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস কত তারিখে?

(ছয় দফা দিবস কত তারিখে, ছয় দফা দিবস কবে, ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস কবে, ছয় দফা দিবস কবে পালিত হয়)
উত্তরঃ ৭ জুন ছয় দফা দিবস।

ছয় দফা দিবস ৭ জুন কেন?

উত্তরঃ ঐ দিন ছয় দফা দাবি ও বাংলার স্বাধিকার আদায়ের জন্য হরতাল পালিত হয়।

ছয় দফা দিবস ক্যানো পালিত হয়?

উত্তরঃ তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া ৬ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের এই তারিখে রাস্তায় নেমে আসে লাখো লাখো মানুষ। হরতাল চলাকালে পুলিশের গুলিতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় নিহত হোন অন্তত ১১জন। তাঁদের স্মরণে এবং জাতীয় মুক্তির স্বারকস্বরূপ এই দিবসটি পালিত হয়ে থাকে।
ছয় দফা রচিত হয়ঃ লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী।

ছয়দফা দাবি মোট কত বার ঘোষনা করা হয়?

উত্তরঃ ৩ বার। যথাঃ
১ম বার- ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬
২য় বার- ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ (বিরোধী দলের সম্মেলনে)
৩য় বার- ২৩ মার্চ, ১৯৬৬ লাহোর (আনুষ্ঠানিকভাবে)

ছয় দফা অনুমোদন পায় কবে?

উত্তরঃ ১৮ মার্চ, ১৯৬৬ সালে, আওমি লীগের বার্ষিক সম্মেলনে।
ছয় দফা এক্সে শিরোনামে পুস্তিকাকারে বের করা হয়ঃ
আমাদের বাচার দাবিঃ ছয় দফা কর্মসূচি (১৮ মার্চ, ১৯৬৬)

ছয় দফা বাস্তবায়নের জন্য হরতাল পালিত হয় কবে?

উত্তরঃ ৭ জুন, ১৯৬৬ সাল। (এই আন্দোলনে মনু মিয়া মারা যান)

ছয় দফার দফাসমূহ (Terms of Six Point Programe)

বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ৬ দফা দাবি লাহােরে উপস্থাপন করেন। এ সময়ে লাহােরে বিরােধীদলগুলাের এক অধিবেশন বসেছিল। এ অধিবেশনে দলের সভাপতি হিসেবে তিনি ছয়দফা দাবি উত্থাপন করেন। পরের দিন ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিভিন্ন পত্রিকায় এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বিবরণী ছাপা হয়। পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, শেখ মুজিবুর রহমান লাহােরে এ প্রস্তাবের পূর্ব পর্যন্ত তার নিজ দল আওয়ামী লীগের অনেক নেতা এ দাবিগুলাে সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। বিষয়টি উত্থাপনের পূর্বে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির অনুমােদন নেন নি। এর ফলে অনেক নেতা কর্মী ক্ষুব্ধ হন এবং অনেকে বিভ্রান্ত হন। কিন্তু ছাত্র লীগের তরুণ কর্মীরা বাঙালির দাবি ৬ দফা, বাঁচার দাবি ৬ দফা, ৬ দফার ভেতরেই পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন নিহিত ইত্যাদি শ্লোগান সম্বলিত পোস্টারে দেয়াল ভরে তােলে।

শেখ মুজিবুর রহমান লাহাের থেকে ঢাকায় ফিরে এসে ১৯৬৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এক সাংবাদিক সম্মেলনে ৬ দফা কর্মসূচি ব্যাখ্যা করেন। ১২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ ও মর্নিং নিউজ এ ৬ দফা ব্যাখ্যাসহ প্রকাশিত হয়। ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ওয়ার্কিং কমিটির কোনাে সভা অনুষ্ঠানের পূর্বেই আওয়ামী লীগের ৫১ পুরানাে পল্টন এর কার্যালয় থেকে প্রকাশিত ও আবদুল মমিন কর্তৃক প্রচারিত শেখ মুজিবুর রহমানের নামে “আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা কর্মসূচি সংক্রান্ত এক পুস্তিকা বিলি করা হয়। উক্ত পুস্তিকায় ৬ দফার অন্তর্ভুক্ত দাবিগুলাে ছিল নিম্নরূপ:

১ম দফা : ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনাপূর্বক পাকিস্তানকে সত্যিকার অর্থে যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে গঠন করতে হবে। এতে সরকার ব্যবস্থা হবে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভাগুলাে হবে সার্বভৌম ।

২য় দফা : যুক্তরাষ্ট্ৰীয় (কেন্দ্রীয়) সরকারের হাতে কেবল দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র এ দুটি বিষয় থাকবে, অবশিষ্ট সকল বিষয় প্রদেশসমূহের হাতে থাকবে।

৩য় দফা : এ দফায় মুদ্রা ব্যবস্থা সম্পর্কে দুটি বিকল্প প্রস্তাব ছিল এবং এদের মধ্যে যে কোনাে একটি গ্রহণের দাবি করা হয় । যথা :
ক. পাকিস্তানের দু’অঞ্চলের জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যােগ্য মুদ্রা চালু থাকবে। এ ব্যবস্থায় মুদ্রার
লেনদেন হিসাব রাখার জন্য দু’অঞ্চলে দুটি স্বতন্ত্র স্টেট ব্যাংক থাকবে এবং মুদ্রা ও ব্যাংক পরিচালনার ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে, অথবা
খ. পাকিস্তানের দু’অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকবে। এ ব্যবস্থায় মুদ্রা থাকবে কেন্দ্রের হাতে। তবে শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকতে হবে যাতে এক অঞ্চল থেকে মুদ্রা অন্য অঞ্চলে পাচার হতে না পারে। এ ব্যবস্থায় পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে এবং দুঅঞ্চলের জন্য দুটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে

৪র্থ দফাঃ সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা ও কর ধার্য এবং আদায়ের ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারে হাতে থাকবে। আঞ্চলিক সরকারে আদায়কৃত অর্থের একটি নির্ধারিত অংশ সংগে সংগে ফেডারেল তহবিলে জমা হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে রিজার্ভ ব্যাংক সমূহের ওপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসন্তন্ত্রে থাকবে। এভাবে জমাকৃত অর্থ দিয়েই ফেডারেল সরকারের তহবিল গঠিত হবে।

৫ম দফাঃ এই দফায় বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপারে নিম্নরূপ শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করা হয়।
ক. দুঅঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক পৃথক হিসাব রাখতে হবে।
খ. পুর্ব পাকিস্থানের অর্জিত বৈদশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্থানের এখতিয়ারে এবং পশ্চিম পাকিস্থানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্থানের এখতিয়ারে থাকবে।
গ. ফেডারেশনের (কেন্দ্রের) জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুওঞ্চল থেকে সমানভাবে অথবা শসনতন্ত্রে নির্ধারিত হারে আদায় হবে।
ঘ. দেশজাত দ্রব্যাদি বিনাশুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানি-রফতানি করা চলবে।
ঙ. ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে বিদেশের সাথে চুক্তি সম্পাদন, বিদেশে ট্রেডমিশন স্থাপন এবং আমদানি-রফতানি করার অধিকাঃ আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করতে হবে।

৬ষ্ঠ দফা : আঞ্চলিক সংহতি ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে প্রদেশগুলােকে নিজস্ব কর্তৃত্বাধীনে প্যারামিলিশিয়া বা আধা সামরিক বাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হবে।

ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য (Reaction, Importance and Significance of Six points Program)

পাকিস্তান ঔপনিবেশিক শাসনামলে পূর্ব বাংলায় যত রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রণীত হয়েছে ৬ দফা ছিল তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ ঘটনার ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সকল আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান তার ছয়দফা দাবির মধ্যে এমন সব দাবি উত্থাপন করেছেন যা বাঙালিকে একটি আলাদা জাতিসত্তা হিসেবে তুলে ধরেছে। এ কারণে ৬ দফা কর্মসূচিকে বাঙালির বাচার দাবি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ৬ দফার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে নিম্নে আলােচনা করা হলাে-

১. বাঙালির মুক্তিসনদ : পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠির অত্যাচার, নিপীড়ন এবং শােষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে ৬ দফা দাবি ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। কারণ পরবর্তীকালে ৬ দফার উপর ভিত্তি করে বাঙালি জাতি তাদের স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়। ৬ দফাকে কেন্দ্র করে মূলত বাঙালিদের মধ্যে একটি নবজাগরণের সৃষ্টি যা বাঙালির মুক্তির জন্য একান্ত অপরিহার্য। এ প্রসঙ্গে বাঙালির জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ৬ দফা বাংলার কৃষক, শ্রমিক, মজুর, মধ্যবিত্ত তথা আপামর মানুষের মুক্তির সনদ এবং বাংলার স্বাধীনতার গ্যারান্টি।

২.শােষণ ও বৈষম্যের প্রতিবাদ : ৬ দফা দাবি ছিল পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পশ্চিমাগােষ্ঠি কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শােষণের বিরুদ্ধে প্রথম বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। কারণ এর পূর্বে বাঙালি জাতির কোনাে নেতা এমন সুসংগঠিত দাবি বাঙালির জাতির সামনে উপস্থাপন করতে সক্ষম হন নি। শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি উত্থাপন কালে বলেছেন “আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা কর্মসূচি।’ সত্যিই শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে বাঁচাতে ছয় দফা কর্মসূচি জনসম্মুখে তুলে ধরেন।

৩. বাঙালি জাতীয়তাবাদের সুদৃঢ় বহিঃপ্রকাশ : ছয় দফা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সুদৃঢ় ঘটেছিল। এ আন্দোলনের সময় সমগ্র বাঙালি জাতি একটি প্লাটফর্মের অধীনে চলে আসে। ৬ দফা দাবি ছিল বাঙালি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার এক মূর্ত প্রতীক এবং এ কারণেই এর প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। ৬ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বাঙালি জাতি ১৯৬৯ এ ঝাপিয়ে পড়েছিল।

৪. স্বায়ত্তশাসনের দাবি : ৬ দফা দাবির মাধ্যমে সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানকে একটি পৃথক অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি পেশ করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচারণার ফলে ৬ দফার দাবি অতি শীঘ্র সমগ্র । বাংলার জনগণের প্রাণের দাবি হয়ে ওঠে। স্বায়ত্তশাসনের দাবি আদায়ের ঢেউ সমগ্র বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে।

৫.স্বাধিকার আন্দোলন : ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বাঙালিরা স্বাধিকার আন্দোলন পরিচালনা করে। তবে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম দিকে এ আন্দোলন তেমন পূর্ণতা পায় নি। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত ৬ দফা দাবি বাঙালি জাতিকে তাদের স্বাধিকার আদায়ের অপরিসীম শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে। যেসব উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে সামনে রেখে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল তার একটিও বাস্তবায়িত না হওয়ায় বাঙালি জাতি ৬ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে স্বাধিকার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।

৬. ১৯৭০ এর নির্বাচনে প্রভাব : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ৬ দফার প্রভাব ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগ ছয় দফা কর্মসূচিকে তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে সন্নিবেশ করে। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ তথা শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচনে জয়লাভ করলে জনগণকে ৬ দফা বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন। ফলে আওয়ামী লীগ উক্ত নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।

৭. আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি : আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম ৬ দফা দাবি পাকিস্তান সরকারের নিকট তুলে ধরেন। তার সুযােগ্য নেতৃত্বে ৬ দফা দাবি সমগ্র বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। ৬ দফা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন এবং আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পায় ।

৮. স্বাধীনতা আন্দোলন : ৬ দফাকে কেন্দ্র করে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত স্বায়ত্তশাসনের দাবি শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। ৬ দফা আন্দোলন ছিল একটি গণমুখি আন্দোলন। ৬ দফা আদায়ের জন্য বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়।

৯. শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা : ৬ দফা কর্মসূচি প্রণয়নের ফলে বাঙালি জাতির রাজনৈতিক জীবনে একটি বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়। কারণ ৬ দফা প্রণয়নে যিনি একক ভূমিকা পালন করেন তিনি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ৬ দফা কর্মসূচি প্রণয়নের ফলে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক আধিপত্য সৃষ্টি হয়। তিনি কলকাতা, ঢাকাসহ সারাদেশে রাজনীতিতে যে খ্যাতি পেয়েছেন তার চাইতে বেশি খ্যাতি অর্জন করেছেন। ৬ দফা আন্দোলনের সিড়ি বেয়ে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করেছেন।
পরিশেষে বলা যায়, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে ৬ দফা কর্মসূচির গুরুত্ব অপরিসীম। অনেকে এটাকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ম্যাগনাকার্টা বলে অভিহিত করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমান যথার্থই বলেছেন, ‘৬ দফা দাবি ছিল বাংলাদেশের বাঁচার দাবি।” (Six Point demand was the element for the survival of the Bangladesh.)

ছয় দফা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (Six point and Bangali Nationalist Movement)

ছয় দফা দাবি ছিল বাঙালিদের বাঁচার দাবি হিসেবে বিবেচিত। এটি ছিল বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক। তাই এর পিছনে ব্যাপক জনসমর্থন সৃষ্টি হয়। এতে ভীত হয়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ৬ দফার সমর্থনকারীদের গােলযােগ সৃষ্টিকারী আখ্যা দেন। তিনি ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে বিভিন্ন জনসভায় ৬ দফা কর্মসূচিকে ষড়যন্ত্রমূলক, রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা ও পাকিস্তান ভাঙ্গার দলিল বলে অভিহিত করেন। পাকিস্তান সরকার যতই নির্যাতনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে ততই ৬ দফা কর্মসূচি বেগবান হতে থাকে।

ছয় দফা আন্দোলন চলাকালে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রথম তিন মাসে মােট ৮ বার গ্রেফতার করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দের নামে বিভিন্ন জেলায় আপত্তিকর বক্তব্য প্রদানের অভিযােগ এনে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু প্রত্যেকটি মামলায় শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ জেল থেকে মুক্তি পান। আইয়ুব-মােনায়েম সরকার এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দলের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের নামে নিত্য নতুন মামলা দায়ের করতে থাকেন। পুনরায় ৮ মে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময়ে সকল রাজনৈতিক নেতার মুক্তির দাবিতে ৭ জুন সারা পূর্ববাংলায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ঐ দিন বিভিন্ন স্থানে পুলিশের গুলিতে শ্রমিক মনু মিয়াসহ ১৩ ব্যক্তি নিহত হয় এবং বহু লােক আহত হয়।

ছয় দফা দিবস

পাকিস্তান সরকার প্রায় ৮০০ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও ছাত্রকে গ্রেফতার করে। ১৫ জুন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক ও বিশিষ্ট সাংবাদিক তােফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। ১৬ জুন ইত্তেফাক, ঢাকা টাইমস ও নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৬৭ সালে সরকার রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন ও পহেলা বৈশাখ উদযাপন নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। তবুও ৬ দফা আন্দোলন পূর্ববাংলায় সুতীব্র গতিবেগ লাভ করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সুদৃঢ়করণে ৬ দফার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ৬ দফা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন। ৬ দফা আন্দোলন পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়।

ছয় দফা দাবির রাজনৈতিক পটভূমি (Political Background of Six point Demand)

১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসনের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই বাঙালিদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা রাজনৈতিক দিক থেকে শােষণের নানা কৌশল উদ্ভাবন করে। পশ্চিমা শাসক গােষ্ঠি শুরু থেকেই বাঙালি জনগােষ্ঠিকে রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। কারণ এ সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের এলিট শ্রেণি পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। বিশেষ করে পূর্ব বঙ্গের কোন নেতাকর্মী যাতে রাজনীতিতে প্রবেশের সুযােগ না পায় তার জন্য তারা কৌশল অবলম্বন করতে হবে। রাজনীতিতে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সীমিত পর্যায়ে অংশগ্রহণ ছিল।

১৯৪৭-১৯৫৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের ৪ জন রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে মাত্র ১ জন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের। কিন্তু তিনিও ছিলেন উর্দুভাষী। একই সময়ে ৭ জন প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে মাত্র ৩ জন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের এবং আবার তাদের মধ্যে একজন ছিলেন উর্দুভাষী। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠি সামান্য অজুহাতে প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দেয় এবং পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে। আইয়ুব খান ১৯৫৯ সালে মৌলিক গণতন্ত্র নামে অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করে। এ ব্যবস্থার অধীনে তিনি পাকিস্তানের জনগণের ভােটাধিকার হরণ করে ১৯৬০ ও ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

ছয় দফা দাবির অর্থনৈতিক পটভূমি (Economical Background of Six point Demand)

বাঙালি জনগােষ্ঠির প্রতি অর্থনৈতিক শােষণই ছিল ৬ দফা কর্মসূচির মূল প্রেক্ষাপট। শিল্প প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বিমা ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত ছিল। এগুলাের অধিকাংশ পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠি নিয়ন্ত্রণ করত। সােজা কথায় বলতে গেলে সকল প্রকার আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা। তারা সকল ব্যবসায় বাণিজ্য নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চালাত। এতে করে স্বাভাবিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত আয় পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেত। পাকিস্তানের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নের মাথাপিছু ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৮০ টাকা। অপরদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ২০৫ টাকা। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য কমানাের পদক্ষেপ নেয়া হলে পূর্বাঞ্চলে মাথাপিছু ব্যয় হয়েছিল ১৯০ টাকা, আর পশ্চিম পাকিস্তানে ২৯২ টাকায় দাঁড়ায়।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলে মাথাপিছু আর প্রায় সমান ছিল। কিন্তু ১৯৫৯-৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ২৭৮ টাকা আর পশ্চিম পাকিস্তানে মাথাপিছু আয় ৩৬৭ টাকায় দাঁড়ায়। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে ৩২% বেশি। ১৯৬০ -৬১ থেকে ১৯৬৪-৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যয় হয়েছিল ৯৭০ কোটি টাকা আর পশ্চিম পাকিস্তানে ২১৫০ কোটি টাকা। অথচ পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৬৫% অর্জিত হতাে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ দিয়ে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের রাজকোষে জমা হতাে ২৫%। উদ্বৃত্ত অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতাে। এই ধরনের বৈষম্যমূলক নীতি ও শােষণের প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা উত্থাপন করেন।

৬ দফা আন্দোলনে সরকারের প্রতিক্রিয়া (Reactions of the Six points Programe)

৬ দফার প্রতি পাকিস্তান সরকারের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত কঠোর ও নেতিবাচক ছিল। তারা ছয় দফাকে রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ না করতে চান নি। তারা একে বিচ্ছিন্নবাদী আন্দোলন বলে প্রচার চালান। লাহােরে ৬ দফা দাবি উত্থাপিত হবার পরদিনই পাকিস্তানে পত্র পত্রিকায় শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে অভিহিত করা হয়। ১৯৬৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের আইন ও সংসদীয় মন্ত্রী আব্দুল হাই চৌধুরী ৬ দফাকে রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা বলে আখ্যায়িত করেন।

১৯৬৬ সালের ১২ মার্চ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঢাকার রমনা গ্রীনে অনুষ্ঠিত বেসিক ডেমােক্রেসী মেম্বারদের সম্মেলনে ৬ দফা সম্পর্কে প্রথম বক্তব্য দেন। তিনি বলেন আজ যারা স্বায়ত্তশাসনের ফমূলা দিচ্ছে, তারা বস্তুত জনগণের মুক্তি চায় না। ৬ দফা প্রণয়নকারী দল পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের শত্রু।” গভর্নর মােনায়েম খান বলেন যে, ৬ দফা আন্দোলনকারীদের কঠোর হস্তে দমন করা হবে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ৬ দফাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, ধ্বংসাত্মক, যুক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেন। আইয়ুব খান শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ১নং দুশমন হিসেবে চিহ্নিত করে ৬ দফার সমর্থকদের দমনে প্রয়ােজনে অস্ত্রের ভাষা ব্যবহারের হুমকি দেন।

৬ দফা আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া (Reaction of Different Political Parties)

আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি ঘােষণা করলে পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এর বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়। পাকিস্তান মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ঘােষণা করা হয় যে, ৬ দফা দাবি পাকিস্তানকে বিভক্ত করা ছাড়া আর কিছুই নয়। কাউন্সিল মুসলিম লীগ ৬ দফাকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার দাবি বলে অভিহিত করে। এ ছাড়া পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক দল জামায়ত-ই-ইসলামি ও নেজাম-ই-ইসলামি শেখ মুজিবের ৬ দফা দাবিকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। এসব দলের মতে, ৬ দফা দাবি ইসলাম ধর্মের অস্তিত্ব বিপন্ন করবে।

পাকিস্তানের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) সভাপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো ৬ দফাকে দেশ বিভাগের ফর্মূলা হিসেবে অভিহিত করে এর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা করেন। মাওলানা ভাসানীর দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ৬ দফার বিরােধিতা করে পাল্টা ১৪ দফা কর্মসূচি ঘােষণা করে। তবে সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলাে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ৬ দফার সমালােচনা করে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ ৬ দফার বিরােধিতা করে সভাস্থল ত্যাগ করেন। ন্যাপ সম্পাদক তােয়াহা বলেন, “৬ দফা হচ্ছে সিআইএ প্রণীত দলিল।”

ছয় দফার পক্ষে আওয়ামী লীগের প্রচারণা (Campaign of Awami League in Favour of Six Point Programe)

১৯৬৬ সালে ৬ দফা কর্মসূচি শেখ মুজিবুর রহমানে রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য। তাই তিনি ৬-দফাভিত্তিক আন্দোলনকে জোরদার করার লক্ষ্যে ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মাস ব্যাপী ব্যাপক গণসংযােগ অভিযান শুরু করেন। এ সময়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বড় বড় শহর-বন্দর ও নগরে সফর সূচি পরিচালনা করেন। এ সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে ৬ দফার পক্ষে দ্রুত জনমত গড়ে উঠতে থাকে। ৬ দফা ভিত্তিক আন্দোলন জোরদার হতে দেখে আইয়ুব মােনায়েম চক্র ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। শেখ মুজিবুর রহমান যেখানেই জনসভা করতে যান সেখানেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। বিভিন্ন স্থানে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। আবার জামিনও পেয়ে যান। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের প্রথম ৩ মাসে তিনি ৮ বার গ্রেফতার হন। ৬ দফা আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য সরকার নির্যাতনমূলক দমননীতি গ্রহণ করে।

৬ দফার প্রচারণায় এক পর্যায়ে ১৯৬৬ সালের ৮মে দেশরক্ষা আইনে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক নেতাকে কারারুদ্ধ করা হয়। এই গ্রেফতারের পূর্বে তিনি ২০ মার্চ থেকে ৮ মে পর্যন্ত ৫০ দিনে ৩২টি জনসভায় ভাষণ দান করেন। ১৯৬৬ সালের ১০ মের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানসহ দলের প্রায় ৩৫০০ নেতা কর্মী গ্রেফতার হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ১৩ মে প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। ছাত্রলীগ ৬ দফার প্রচারণায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ছাত্র লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক ৬ দফা কর্মসূচির ৫০,০০০ লিফলেট ছাপিয়ে জনসাধারণের মধ্যে বিলি করেন।

১৯৬৬ সালের ২ জুন শেখ মুজিবুর রহমানসহ আটক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে আওয়ামী লীগ সারা পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালনের ডাক দেয়। সরকার হরতাল বন্ধ করার জন্য হুশিয়ারি উচ্চারণ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে ৭ জুন সারা পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালিত হয়। হরতালের সময় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীতে পুলিশের গুলিতে ১৩ ব্যক্তি নিহত হয় ও বহু লােক আহত হয়। ৭ জুনের ঘটনার প্রতিবাদে ৮ জুন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সভা থেকে বিরােধী দল ওয়াক আউট করে এবং একই দিন প্রাদেশিক পরিষদ থেকে বিরােধী দলসহ স্বতন্ত্র সদস্যগণ ওয়াক আউট করেন। আইয়ুব মােনায়েম সরকার কর্তৃক ১৫ জুন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক তােফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। ১৬ জুন ইত্তেফাক, টাইমস ও নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস নিষিদ্ধ ঘােষিত হয়।

১৯৬৬ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ৯,৩৩০ জন আওয়ামী লীগ কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। তবুও ৬ দফা আন্দোলন দেশব্যাপী অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং এটি আপামর জনগণের সমর্থন লাভ করে। ইতােমধ্যে ৫টি বিরােধী দল ৮ দফার ভিত্তিতে Pakistan Democratic Movement (PDM) নামে একটি ঐক্যজোট গঠন করে। কিন্তু PDM নেতৃবৃন্দের প্রতি জনগণের তেমন আস্থা না থাকায় তারা তাদের দাবির সমর্থনে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়।

আরো দেখুনঃ

বিজয় দিবস অনুচ্চেদ রচনা

স্বাধীনতা দিবস অনুচ্ছেদ রচনা

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের শুভেচ্ছা স্ট্যাটাস, উক্তি, ছন্দ, বাণী, কবিতা এবং ক্যাপশন

বঙ্গবন্ধুর জীবনী অনুচ্ছেদ রচনা

৭ই মার্চের ভাষণ অনুচ্ছেদ রচনা

জাতীয় শোক দিবস অনুচ্ছেদ রচনা

ভাষা আন্দোলনে নারীদের অবদান – The Contribution of women in the Language movement

ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ভাষা সৈনিকদের পরিচিতি

ভাষা আন্দোলনের শহীদদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

একুশে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে ১০ টি বাক্য

বাংলা নববর্ষ / পহেলা বৈশাখ অনুচ্ছেদ রচনা

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অনুচ্ছেদ রচনা

Rate this post

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top