৭ই মার্চের ভাষণ অনুচ্ছেদ রচনা

7 march speech

৭ই মার্চের ভাষণ – এক ঐতিহাসিক বিষ্ময়

ভূমিকা :

‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তােমার শেখ মুজিবুর রহমান’– অন্নদাশঙ্কর রায়।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও বাঙালি জাতির অবিসংবাদী নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি ও বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের পুরােধা ব্যক্তিত্ব। তাঁর হাত ধরেই আমরা পেয়েছি প্রিয় স্বাধীনতা। সুদীর্ঘকাল ধরে বাঙালি জাতি বিদেশি শাসক-শােষক দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছে। কিন্তু কখনাে কোনাে নেতা বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই এই অত্যাচারিত ও নিপীড়িত জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার পথও নির্দেশ করেছিলেন। আর তাঁর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এ ভাষণটি বাঙালির জীবনে সাফল্যের মাইলফলক ও এক অনবদ্য মহাকাব্যপ্রতিম সৃষ্টি।

ইতিকথা :
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ অধ্যুষিত ভারত ভেঙে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে পূর্ববাংলার মানুষ যুক্ত হয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে। তখন পূর্ববাংলার নামকরণ করা হয় পূর্ব পাকিস্তান। বাঙালি জাতি ভেবেছিল, পাকিস্তান রাষ্ট্রে ঔপনিবেশিক নিপীড়ন আর থাকবে না। কিন্তু তা হয়নি, অল্প কিছুদিন পরেই পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর হিংস্র রূপ বাঙালির সামনে উন্মােচিত হয়। তারা এ দেশের মানুষের প্রতিবাদ দমাতে প্রথমেই আঘাত হানে মাতৃভাষা বাংলার ওপর। তারা শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের মুখের ভাষাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নেয়।

এতে বুঝতে বাকি থাকে না যে তারা এ দেশের মানুষের সংস্কৃতিকে ধ্বংসের হীন খেলায় মেতে উঠেছে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ঢাকায় এক জনসভায় গভর্নর মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘােষণা দেন, “উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ কিন্তু তার সিদ্ধান্ত বাংলার মানুষ মেনে নেয়নি। তারা এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছে। সর্বশেষ ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে বুকের রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলা ভাষার মর্যাদা। এরপর ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি পাকিস্তানিদের সমুচিত জবাব দেয়। কিন্তু বাঙালির এ জয় বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে এ দেশের মানুষকে দশ বছর পর্যন্ত গােলাম করে রাখে। ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে বাঙালি জাতির।

মুক্তির সনদখ্যাত ৬দফা দাবি আন্দোলন, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতনের জন্য ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থান হয়। এরপর ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খান সমঝােতায় এলে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। এ নির্বাচনে জয়লাভ করে বাঙালি জাতির আশা-ভরসার একমাত্র আশ্রয়স্থল শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। কিন্তু তারপর পাকিস্তানি শােষকরা বাঙালির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বরং উল্টো অত্যাচার-নিপীড়ন শুরু করে। পাকিস্তানিদের এ স্বৈরাচারী আচরণ এ সময় বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুঝতে পারেন। তাই তিনি সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী অসহযােগ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং পরবর্তী সময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়।

পাকিস্তানিদের বৈষম্য নীতি ;
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী বাঙালিদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে। তারা এ দেশের মানুষকে দমিয়ে রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক প্রতিটি ক্ষেত্রে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের তেমন সুযােগ দিত না। জাতীয় বাজেটের সিংহভাগ বরাদ্দ থাকত পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। এ ছাড়া সামরিক বাহিনীতে মাত্র পাঁচ ভাগ বাঙালি কর্মকর্তা ছিলেন। আর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তারা কখনাে বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দিতে চাইত না। উল্টো অত্যাচার করে দমিয়ে রাখতে চাইত।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব :
বাঙালি জাতির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর দৃঢ় নেতৃত্ব আর জনপ্রিয়তার কাছে পরাজিত হয়েছিল পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠী। তিনি ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তার অবদান অপরিসীম। ১৯৫৪ সালে তিনি যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে গণপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে বাঙালি জাতির ওপর কর্তৃত্ব ফলাতে থাকে। এমন সময় বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য ৬ দফা দাবি পেশ করেন।

কিন্তু পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠী এটি প্রত্যাখ্যান করে তাঁর নামে অপপ্রচার চালায়। ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে শাসক গােষ্ঠী তাকে দমন করতে চেয়েছিল। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানেও তার ভূমিকা অশেষ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন যেন বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তারই প্রতিফলন। কিন্তু এরপরও পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠী নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে এক অসহযােগ আন্দোলনের ডাক দেন; যা বাঙালি

৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ :
১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পতন হয়। এরপর ক্ষমতায় আসে আরেক পশ্চিমা শাসক ইয়াহিয়া খান। তিনি ক্ষমতায় এসে গণ-আন্দোলনের কারণে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। এ নির্বাচনে জয়লাভ করে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। গণতন্ত্রের ধারা অনুসারে শাসনক্ষমতা পাওয়ার কথা আওয়ামী লীগেরই। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠী কখনােই বাঙালির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি ছিল না। তারা চাইত সব সময় বাঙালিরা তাদের হাতের পুতুল হয়ে থাকুক। তাই তারা গণতন্ত্র হত্যার হীন খেলায় মেতে ওঠে। তারা কোনাে কারণ ছাড়াই গণপরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া বাঙালি জাতির ওপর শুরু করে দমন-পীড়ন ও নির্যাতন।

এর প্রতিবাদে সারা বাংলায়  প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বাঙালি জাতি গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে সােৎসাহে যােগ দেয়। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রায় দশ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে ১৮ মিনিটব্যাপী এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এই ভাষণটি ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। যা পরবর্তী কালে বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের প্রধান দিকনির্দেশনা হিসেবে ভূমিকা রাখে। নিচে এ ভাষণটির তাৎপর্যপূর্ণ দিকগুলাে ব্যাখ্যা করা হলাে-

i. সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালােচনা :
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের সামগ্রিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি তুলে ধরেন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বর্বর অত্যাচারের কথা। গণতন্ত্রের বিজয় হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকরা তা মেনে না নিয়ে বাঙালি নিধনে মেতে ওঠে; যা বাংলার মানুষ মেনে নেয়নি কখনাে। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’

ii. বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ও অবস্থান ব্যাখ্যা :
একজন শান্তিকামী নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু বারবার আলােচনার মাধ্যমে সংকট মােকাবিলা করতে চেয়েছিলেন। আর তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিতও ছিল ভাষণের মধ্যে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠী তা উপেক্ষা করে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে বসে থাকতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন চালিয়ে যাওয়ার অনুরােধ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর যৌক্তিক কোনাে দাবিই শাসকগােষ্ঠী মেনে নেয়নি। উল্টো তারা দমন-পীড়নের মাধ্যমে বাঙালি নিধনে মেতে ওঠে।

iii. পাকিস্তানি রাজনীতিকদের ভূমিকা :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য বারবার জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের মাধ্যমে পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর সঙ্গে আলােচনা করতে চেয়েছেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠী কখনােই তা সমর্থন করেনি। কারণ এতে তারা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ভয় পেত। তাই ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ অন্যরা নানা উপায়ে আলােচনা এড়াতে চেয়েছিল। তারা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং তাঁর নামে নানা অপপ্রচার চালাতে থাকে।

iv. সামরিক আইন প্রত্যাহারের আহবান :
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠী সামরিক আইন জারি করে বাংলার মানুষকে জিম্মি করে রেখেছিল। তারা ভেবেছিল, অস্ত্র দ্বারা দমন করবে বাঙালিকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠীর এ হীন চেষ্টা বুঝতে পেরে এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তিনি এ ভাষণের মাধ্যমে সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছিলেন।

v. অত্যাচার ও সামরিক আগ্রাসন মােকাবিলার আহ্বান :
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী বেপরােয়া হয়ে উঠেছিল, বাঙালি নিধনে মেতে উঠেছিল। তারা ভেবেছিল, বাঙালি ভীরু জাতি। তাই এদের অস্ত্র দ্বারা দমন করবে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের এ হীন নীতি বুঝতে পেরে এর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার আহ্বান করেছিলেন। ৭ই মার্চের ভাষণে তিনি ঘােষণা করেছিলেন, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােলাে। তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু- আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তােমরা বন্ধ করে দেবে।

vi. দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কোনাে বিকল্প নেই। কেননা আন্দোলন ব্যতীত কখনাে বাংলার মানুষ মুক্তি লাভ করতে পারবে না। তাই তিনি এই ভাষণে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন অনির্দিষ্ট কালের জন্য শান্তিপূর্ণ হরতাল পালনের। এ ছাড়া সব ধরনের কর না দেওয়ারও আহ্বান করেছিলেন। সরকারি অফিস-আদালত বন্ধ করে সবাইকে দাবি। আদায়ে আন্দোলন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।

vii. অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও সম্প্রীতির আহবান :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী ধর্ম দিয়ে এ দেশের মানুষকে পৃথক করার চেষ্টা করবে। তাই তিনি এই ভাষণের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রেখে ঐক্যবদ্ধ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতাসংগ্রামে অগ্রসর হওয়ার আহ্বান করেছিলেন।

viii. নিগ্রহ আক্রমণ প্রতিরােধের আহ্বান :
পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠী এ দেশের মানুষকে চিরদিনের জন্য দাসত্বের নিগড়ে বন্দী করে রাখতে চেয়েছিলাে। তাই তারা অত্যাচারের নানা পথ বেছে নিয়েছিল। তারা ভেবেছিল, অস্ত্রের মুখে এ দেশের মানুষকে চিরদাসে পরিণত করবে; যা বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন এবং এই ভাষণের মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে সাধারণ মানুষকে আহ্বান করেছিলেন।

ix. স্বাধীনতার ডাক :
বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ এই ভাষণের শেষ পর্যায়ে তিনি স্বাধীনতার ডাক দেন। তিনি ভাষণের সর্বশেষে বলেন-

“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”

ভাষণ-পরবর্তী অবস্থা :
আবেগে, বক্তব্যে, দিকনির্দেশনায় এই ভাষণটি ছিল অনবদ্য। যা স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বাঙালি জাতির জন্য দিকনির্দেশনা হিসেবে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। মূলত বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দিকে চেয়েছিল। পরােক্ষভাবে সেদিন তারা নিজেদেরকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে ফেলেছিল। আর ভেতরে ভেতরে চলছিল মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক প্রস্তুতি। তেজোদীপ্ত বাঙালি তখন জয় বাংলা মন্ত্রে উজ্জীবিত ছিল।

৭ই মার্চ ভাষণের বিশ্বস্বীকৃতি :
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, তা ছিল বাঙালি জাতির স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়ার মূলশক্তি। এ ভাষণটি সর্বমােট ১২টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এই ভাষণের জন্য ‘ নিউজউইক ম্যাগাজিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০১৭ সালের ৩০শে অক্টোবর ইউনেস্কো এই ভাষণকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউনেস্কো পুরাে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দলিল সংরক্ষণ করে থাকে। মেমােরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে ৭ই মার্চের
ভাষণসহ মােট ৪২৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথি সংগৃহীত হয়েছে।

উপসংহার :
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে রচিত হয়েছিল এক অনবদ্য মহাকাব্য। আর এ মহাকাব্যের রচয়িতা বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর হাত ধরেই এসেছে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা। তার এই ভাষণটি ১৯৭১ সালে দিশেহারা বাঙালি জাতিকে দেখিয়েছিল মুক্তির পথ। তারা স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সে ভাষণের ভাব-গাম্ভীর্য ও প্রতিচ্ছবির সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে কবি নির্মলেন্দু গুণে’র “স্বাধীনতা এ শব্দটি কীভাবে আমাদের হলাে” কবিতায় –

‘একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভাের থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে : কখন আসবে কবি?

শত বছরে শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতাে দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খােলা। কে রােধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাপিয়ে কবি শােনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি :

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

আর স্বাধীনতার এত বছর পর ইউনেস্কো ঐ ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে যে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য গর্বের ও প্রেরণার।

দেখুনঃ

বিজয় দিবস অনুচ্চেদ রচনা

স্বাধীনতা দিবস অনুচ্ছেদ রচনা

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের শুভেচ্ছা স্ট্যাটাস, উক্তি, ছন্দ, বাণী, কবিতা এবং ক্যাপশন

বঙ্গবন্ধুর জীবনী অনুচ্ছেদ রচনা

জাতীয় শোক দিবস অনুচ্ছেদ রচনা

একুশে ফেব্রুয়ারি অনুচ্ছেদ রচনা- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অনুচ্ছেদ রচনা

ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস এবং এর গুরুত্ব, তাৎপর্য, রাজনৈতিক পটভূমি, অর্থনৈতিক পটভূমি ও দফাসমূহ

ভাষা আন্দোলনে নারীদের অবদান – The Contribution of women in the Language movement

ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ভাষা সৈনিকদের পরিচিতি

ভাষা আন্দোলনের শহীদদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

একুশে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে ১০ টি বাক্য

Rate this post

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top