বিজয় দিবস অনুচ্চেদ রচনা। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আমাদের এখানে ৩ টি আলাদা আলাদা অনুচ্ছেদ রচনা উপস্থাপন করা হয়েছে। আপনারা প্রয়োজন অনুযায়ী এখানে থেকে অনুচ্ছেদ রচনা সংগ্রহ করে নিতে পারেন। ১৬ই ডিসেম্বর উপলক্ষে যারা অনুচ্ছেদ রচনা সংগ্রহ করতে অনলাইনে খোঁজাখুঁজি করছেন তারা এখানে পছন্দের অনুচ্ছেদ রচনা পেয়ে যাবেন আশা করি। -Victory Day Essay
বিজয় দিবস অনুচ্ছেদ রচনা (১)
ভূমিকা:
১৬ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনে বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হয় এবং এ দিনটি আমাদের প্রাণের রক্তেও অভিষিক্ত। ১৯৭১ সালের এই দিনটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সফল পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। তাই বাঙালির জাতীয় জীবনে বিজয় দিবস লাল রক্তে রাঙানো। ১৬ ডিসেম্বর ঘুরে ঘুরে আমাদের নিকট প্রতি বছর উপস্থিত হয়। আমরা পিছন ফিরে অতীত ইতিহাস দেখি।
পটভূমি :
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর ঔপনিবেশিক পাক হানাদার
বাহিনীর বর্বর অভিযানের মুখে সারা বাংলাদেশ এক দুঃস্বপ্নের সাগরে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। ত্রিশ লক্ষ নর-নারী হানাদার বাহিনীর বর্বর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল, ইজ্জত হারিয়েছিল দুই লক্ষ মা-বোন। খালে-বিলে, নদী-নালায় কত মুক্তিসেনার বুকের রক্ত মিশে গিয়েছে, লাশের পর লাশ স্তূপীকৃত হয়ে কত বধ্যভূমি রচিত হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।
২৫ মার্চের ভয়ঙ্কর কালো রাতের অন্ধকার পর্দা ভেদ করে দীর্ঘ নয় মাসের শ্বাসরুদ্ধকর দুঃস্বপ্নের পর ১৬ ডিসেম্বর সেই কোটি হৃদয়ের কামনার ধন স্বাধীনতার রক্তে রঙিন পতাকা বিজয়ের গৌরবে উড্ডীন হয়েছে। তাই ১৬ ডিসেম্বর একটা মামুলি জাতীয় দিবস নয়। এর সাথে জড়িত রয়েছে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, গণতান্ত্রিক চেতনা, শৌর্য-বীর্য, ত্যাগ ও মহত্ত্বের মহিমা। ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস হিসেবে আমাদের দ্বারে সমাগত হলে আমরা তাই আমূল আলোড়িত হই এবং আত্মস্থ হয়ে আগামী দিনে দেশ গঠনের সংগ্রামে শপথ গ্রহণ করি।
বিজয় দিবস উদযাপন :
বিজয় দিবস সরকারি ছুটির দিন। রাজধানীসহ অন্যান্য শহরকে সাজানো হয় নানা রঙের আলোকসজ্জা
দিয়ে। সরকারি, আধা-সরকারি ও বেসরকারি অফিসগুলোতে জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয়। শহিদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধে
পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এমনিভাবে অত্যন্ত গুরবত্বের সাথে বিজয় দিবস উদযাপিত হয়।
আত্মসমীক্ষা :
১৯৭১ থেকে বর্তমান পর্যন্ত এই দীর্ঘ বছরের পথ পরিক্রমায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাঙালি জাতির জীবনে কতটুকু তাৎপর্য দান করেছে এটা আমাদের অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে। কোনোরূপ বিতর্কে না গিয়ে আমরা বিশ্বজনীন আবেদনে সাড়া দিয়ে শুধু স্বাধীনতার মৌল প্রশ্নে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করি। যে মহান আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সামনে রেখে স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল, দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ চলেছিল তা আজ স্বাধীনতা লাভের সাতচল্লিশ বছর পর কতটুকু কার্যকরী ও তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে আমাদের হিসেব করে দেখতে হবে।
বিজয় দিবসের তাৎপর্য :
যাঁদের শ্রম ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে তাঁদের মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করাই বিজয় দিবসের প্রধান দাবী। মুক্তিযোদ্ধারা যে স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্যে মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছিলেন, তাঁদের স্বপ্ন-আশা বাস্তবায়িত করা বিজয় দিবসের মূল লক্ষ্য ও আমাদের দায়িত্ব। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ছাড়া আমাদের সাফল্য ছিল সুদূর পরাহত। তাই আমাদের জাতীয় জীবনে বিজয় দিবসের তাৎপর্য অপরিসীম।
জনগণের চেতনা :
জনগণ সচেতন না হলে দেশের কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডই ফলপ্রসূ হতে পারে না। অজপাড়া গাঁ থেকে শহর- কদর পার হয়ে রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত একই চেতনা, একই লক্ষ্য ও অভিন্ন কর্মসূচি প্রবাহিত না হলে জাতীয় ঐক্য রক্ষা করা মুকঠিন। বাংলাদেশকে মুষ্টিমেয় ধনিক, বণিক ও চাটুকার রাজনীতিকদের খাস তালুক বানাবার নীল নকশায় আনা হলে স্বাধীনতার কোনো রকম আস্বাদ গ্রহণ সাধারণের পক্ষে সম্ভব হবে না।
উপসংহার :
সরকারি, বেসরকারি, রাজনীতিক, অরাজনীতিক সব মহলের একান্ত প্রয়োজন বাংলাদেশের বিদ্যমান সমস্যা সংকটে বিভেদ বিসম্বাদ ভুলে স্বাধীনতার স্বাদ ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগণকে সচেতন ও শ্রমশীল করার জন্য, স্বাধীনতার আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পুরাপুরি অর্জনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়া। পথের জঞ্জাল সরিয়ে দেশ গঠনে ও সমৃদ্ধিশালী ভবিষ্যৎ রচনার সংগ্রামে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শান্তি ও সুখ-সমৃদ্ধির জন্য একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের শহতী চেতনা আবার জাগরিত করে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা।
বিজয় দিবস অনুচ্ছেদ (২)
সূচনা :
বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় জীবনে ১৬ ডিসেম্বর এক অবিস্মরণীয় ও গৌরবজনক দিন। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস। যুদ্ধের পর ১৯৭১-এর এই দিনে অর্জিত হয় মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় বিজয়।
পটভূমি :
দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে এ উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তান নিয়েই পাকিস্তান রাষ্ট্রটি গঠিত হয়েছিল। কিন্তু শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকবর্গ পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার প্রতি নানাবিধ শোষণের চক্রান্তে মেতে ওঠে। এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে রাজনীতি, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থ-সম্পদসহ সর্বত্রই অতিরিক্ত বৈষম্যের মধ্য দিয়ে।
১৯৫২ সালে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার গভীর চক্রান্তে মেতে ওঠে শাসকচক্র। আর রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ফেটে পড়ে ছাত্র-জনতা। সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, আযাদসহ আরও অনেকে জীবন দেয় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে। শুরু হয় বাঙালির অস্তিত্বের সংগ্রাম স্বাধিকার আন্দোলন।
বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার জন্য পূর্ণ সচেতনতা ও প্রস্তুতির ঘোষণা দেন। ১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চ রাতে বর্বর হায়েনা পাকিস্তানি বাহিনী এদেশের ঘুমন্ত- নিরীহ জনগণের উপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মর্মান্তিক আক্রমণ চালায়। গ্রেপ্তারের পূর্বমুহূর্তে স্বাধীনতার ডাক দেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বীর বাঙালি। শুরু হয় এ দেশে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ঘটনা— মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চলে মুক্তিসেনাদের সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। যুদ্ধে প্রায় ত্রিশ লক্ষ বাঙালি জীবন বিসর্জন দেয়। দুই লক্ষ মা-বোন সম্ভ্রম হারায়। অবশেষে ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালির বিজয় সূচিত হয়।
বিজয় দিবসের তাৎপর্য :
ত্রিশ লক্ষ জীবনের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। অনেক অশ্রু বিসর্জনে পাওয়া এ স্বাধীনতা আমাদের কাছে অত্যন্ত গৌরবের। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বয়ে নিয়ে চলেছে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পতাকা, গাইছে বিজয়ের গৌরবগাথা। তাই বিজয় দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতি বছর এই দিনটি পালনের মাধ্যমে আমরা নতুন প্রজন্মকে এবং বিশ্বকে বারবার মনে করিয়ে দিই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা, বীর শহিদদের কথা। আমরা অনুপ্রাণিত হই আমাদের দেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা স্মরণ করে। উদ্বুদ্ধ হই অগ্রগতি আর প্রগতির পথে সোনার বাংলা গড়তে।
বিজয় দিবস উদযাপন :
বিজয় দিবস উদযাপিত হয় মহাসমারোহে। এ দিন সারাদেশ ছেয়ে যায় লাল-সবুজের সাজে। বাড়ির ছাদে, দোকানে, রাস্তার পাশে, গাড়ির সামনে, স্কুল-কলেজে, এমনকি রিকশার হ্যান্ডেলেও শোভা পায় লাল-সবুজ রঙের জাতীয় পতাকা। প্রতিটি শহরে পরিলক্ষিত হয় উৎসবের আমেজ। রাজধানী ঢাকার রাস্তায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী আয়োজন করে গণমুখী নানা অনুষ্ঠানের। স্বাধীনতার আবেগে উদ্বেলিত নর-নারী উৎসবের সাজে সেজে সেখানে জমায়েত হন। স্কুল-কলেজে ছাত্র-ছাত্রীরা নানারকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
এই দিন সকালবেলা ঢাকার জাতীয় প্যারেড ময়দানে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য, কূটনীতিবিদ, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে হাজার হাজার মানুষ এই কুচকাওয়াজ উপভোগ | করেন। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ও অন্যান্যরা জাতীয় স্মৃতিসৌধে এ দিন পুষ্প অর্পণ | সংসদে সাংসদ ও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। চট্টগ্রামে বিজয় দিবস উপলক্ষে ৭ দিনব্যাপী ঐতিহ্যবাহী
বিজয় মেলার আয়োজন করা হয়।
বিজয় দিবস ও বর্তমান বাস্তবতা :
শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জিত হলেও আমাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবের আঘাতে আজ ছিন্নভিন্ন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনেক কিছুই এখন চলে গেছে আড়ালে। স্বাধীনতার শত্রুদের গাড়িতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয়েছে। গণতন্ত্রের পরিবর্তে বারবার সামরিক শাসন এসেছে। আর্থনীতিক মুক্তি অর্জন এখনও সম্ভব হয়নি। সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শ হয়েছে পরিত্যক্ত। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় যে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল তা বিভেদ ও সংঘাতে পর্যবসিত। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বিজয় দিবসের তাৎপর্য থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
উপসংহার :
‘স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন’ এই সত্য বাক্যটিকে বক্ষে ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে। বিজয় দিবস বাঙালি জাতিসত্তার জন্য অত্যন্ত গৌরবের। এ দিবসটি আনন্দের হলেও এর সাথে জড়িয়ে আছে শহিদদের স্মৃতি, স্বজন হারানোর বেদনাময় আর্তনাদ আর যুদ্ধাহত ও ঘরহারা মানুষের দীর্ঘশ্বাস। এ দিনটি শুধু আমাদের বিজয়ের দিন নয়, এটি আমাদের চেতনাকেও শাণিত করে।
বিজয় দিবস রচনা (৩)
সূচনা :
আমাদের জাতীয় জীবনে ১৬ই ডিসেম্বর সবচেয়ে আনন্দ ও গৌরবের একটি দিন। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর এই দিনে আমাদের প্রিয় স্বদেশ দখলদারমুক্ত হয়েছিল। লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম। পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ লাভ করেছিলাম। এই দিনটি তাই আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে স্মরণীয় দিন। এটি আমাদের ‘বিজয় দিবস’।
বিজয় দিবসের ইতিহাস :
বিজয় মহান, কিন্তু বিজয়ের জন্য সংগ্রাম মহত্তর। প্রতিটি বিজয়ের জন্য কঠোর সংগ্রাম প্রয়োজন। আমাদের বিজয় দিবসের মহান অর্জনের পেছনেও বীর বাঙালির সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মদানের ইতিহাস রয়েছে। পাকিস্তান সৃষ্টির প্রায় প্রথম থেকেই বাঙালিদের মনে পশ্চিমা শোষণ থেকে মুক্তিলাভের ইচ্ছার জাগরণ ঘটে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নানা আন্দোলনের মাধ্যমে তা প্রবল আকার ধারণ করতে থাকে।
অবশেষে বাঙালির স্বাধিকার চেতনা ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয় । বাঙালির স্বাধিকারের ন্যায্য দাবিকে চিরতরে নির্মূল করার জন্য ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পশ্চিমা সামরিক জান্তাবাহিনী বাঙালি-নিধনের নিষ্ঠুর খেলায় মেতে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বাঙালিরা রুখে দাঁড়ায়। গর্জে ওঠে। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলে। কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পী-সাহিত্যিক, নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান— সবাইকে নিয়ে গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী। যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশমাতৃকার মুক্তি-সংগ্রামে। সুদীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ চলে।
পাকিস্তানি সামরিক জল্লাদরা এ সময় গ্রামে-গঞ্জে শহরে-বন্দরে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে নিরীহ জনসাধারণকে। ঘর- বাড়ি, দোকান-পাট লুট করে জ্বালিয়ে দেয়। মা বোনদের ওপর পাশবিক নির্যাতন করে। প্রাণ বাঁচাতে সহায়- সম্বলহীন এক কোটি মানুষকে আশ্রয় নিতে হয় প্রতিবেশী দেশ ভারতে। তবু বাঙালি দমে যায় নি। পৃথিবী অবাক তাকিয়ে দেখে :
সাবাস বাংলাদেশ! এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয় :
জ্বলে-পুড়ে-মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়।
অবশেষে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজয় স্বীকার করে নেয়। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর এদেশের মুক্তিসেনা ও মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। রক্তাক্ত সংগ্রামের অবসান ঘটে। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। সূচিত হয় বাংলাদেশের মহান বিজয়।
বিজয় দিবসের তাৎপর্য :
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর গৌরবময় বিজয়ের মাধ্যমে স্বাধীন জাতি হিসেবে বাঙালির জয়যাত্রার শুরু। এই দিনে স্বপরিচয়ে আমরা বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগ পাই। এই দিনটির জন্যই সারা বিশ্বে বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের মর্যাদা আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। ১৬ই ডিসেম্বর তাই আমাদের বিজয় দিবস। প্রতি বছর সবিশেষ মর্যাদা নিয়ে জাতির কাছে হাজির হয় বিজয় দিবস। সব অন্যায়- অত্যাচার, শোষণ-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিজয় দিবস আমাদের মনে প্রেরণা সৃষ্টি করে।
বিজয় দিবসের উৎসব :
১৬ই ডিসেম্বর ভোরে সাভারে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্যে দিয়ে দিবসটির শুভ সূচনা হয়। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ মহাসমারোহে বিজয় দিবস পালন করে। ১৫ই ডিসেম্বর রাত থেকেই বিজয় দিবস উদযাপনের প্রস্তুতি চলে। দেশের সমস্ত স্কুল-কলেজ, ঘর-বাড়ি, দোকানপাট, রিক্সা-গাড়ি ইত্যাদিতে শোভা পায় লাল-সবুজ পতাকা। স্কুল-কলেজ কিংবা রাস্তায় রাস্তায় আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। স্বাধীনতার আনন্দে সব শ্রেণির মানুষ যোগ দেয় এসব অনুষ্ঠানে। কোথাও কোথাও বসে বিজয় মেলা।
সরকারি ব্যবস্থাপনায় এদিনটি বেশ জাঁকজমকভাবে পালন করা হয় । ঢাকার জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে বাংলাদেশ সামরিক ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যগণ কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য, বিরোধীদলীয় নেতা-নেত্রীগণ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে হাজার হাজার মানুষ এই কুচকাওয়াজ উপভোগ করেন। বিজয় দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন কাঙালিভোজের আয়োজন করে থাকে।
অনেক সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিজয় দিবস স্মরণে অনুষ্ঠান করে। পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয় বিশেষ ক্রোড়পত্র। বেতার ও টেলিভিশনে প্রচারিত হয় বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের আত্মার শান্তি ও দেশের কল্যাণ কামনায় প্রার্থনা করা হয়। শহরে সন্ধ্যায় আয়োজন করা হয় বিশেষ আলোকসজ্জার। সমগ্র দেশ জুড়ে উৎসবমুখর পরিবেশে বিজয় দিবস পালিত হয়।
উপসংহার :
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এই স্বাধীনতা আমাদের অর্জিত হয় ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। এই দিনটি শুধুই আমাদের বিজয়ের দিন নয়, বেদনারও দিন। আমাদের চেতনা জাগরণেরও দিন। যাঁদের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও রক্তের বিনিময়ে আমরা এই গৌরবের অধিকার পেয়েছি, তাঁদের সেই আত্মোৎসর্গের কথা মনে রেখে আমাদেরও সেই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে। দেশ ও জাতিকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তবেই বিজয় দিবসের মহিমা অর্থবহ হয়ে উঠবে।
আরো দেখুনঃ
- স্বাধীনতা দিবস অনুচ্ছেদ রচনা।২৬শে মার্চ অনুচ্ছেদ রচনা
- ৭ই মার্চের ভাষণ অনুচ্ছেদ রচনা
- বঙ্গবন্ধুর জীবনী অনুচ্ছেদ রচনা | ছোটদের বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচনা | বঙ্গবন্ধুর জীবনী সংক্ষেপে রচনা
- বাংলা নববর্ষ / পহেলা বৈশাখ অনুচ্ছেদ রচনা
- একুশে ফেব্রুয়ারি অনুচ্ছেদ রচনা- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অনুচ্ছেদ রচনা
- জাতীয় শোক দিবস অনুচ্ছেদ রচনা
- করোনা ভাইরাস অনুচ্ছেদ রচনা
- ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের কবিতা এবং বক্তব্য
- ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস
- ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস এবং এর গুরুত্ব, তাৎপর্য, রাজনৈতিক পটভূমি, অর্থনৈতিক পটভূমি ও দফাসমূহ
- ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ভাষা সৈনিকদের পরিচিতি
- ভাষা আন্দোলনের শহীদদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি